সেলফি ডিপ্লোমেসি: ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

লেখক :ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন পাকিস্তান সফরে এসে ২৪ ঘণ্টার জন্য নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। পরে জানা গেল, ওই সময়টায় গোপনে চীন সফর করেছিলেন কিসিঞ্জার। পিংপং বলের মত কিসিঞ্জারের এই ইসলামাবাদ-বেজিং ছোটাছুটি ইতিহাসে খ্যাতি পেয়েছিল ‘পিংপং ডিপ্লোমেসি’ নামে। সে সময়কার বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কিসিঞ্জারের ‘পিংপং ডিপ্লোমেসি’ ছিল গেম চেঞ্জার। কারণ ওই সময়ে ওয়ার্ল্ড অর্ডার ছিল দুই মেরুকেন্দ্রিক।

একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোট আর অন্যদিকে অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ওয়ারশ প্যাক্টের চাপে চিরে-চ্যাপ্টা বিশ্ব ব্যবস্থায় সে সময়ে এই দুই ধারার বাইরে থাকা দেশগুলোর বাঁচার ছাতা ছিল জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যাম। এসব কিছুর বাইরে থাকা তখন উঠতি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বরফটা গলাতেই কিসিঞ্জার ইসলামাবাদ সফরে এসে পিকিং, আজকের বেজিংয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন।
একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানের যে নির্বিচার আগ্রাসন, সে সময়কার বিশ্বব্যবস্থার বাস্তবতায়, তাতে পাকিস্তানের মূল চালিকাশক্তি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের নিঃশর্ত সমর্থন। আর সেদিনের পাকিস্তানও ছিল আজকের তুলনায় অনেক সবল। তারা যে শুধু বিশে^র চতুর্থ সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র ছিল তাই-ই নয়, সে সময়কার ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও পাকিস্তানের গুরুত্বটা ছিল অনেক বেশি, যা আজকের পাকিস্তানের সাপেক্ষে মাপলে হবে বোকামি। সে কারণেই মার্কিন-চীন সম্পর্কের সূচনার চারণভূমি হিসেবে এই দুই দেশ পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিল। আর সে কারণেই কিসিঞ্জারের ‘পিংপং ডিপ্লোমেসি’।
বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ পিংপং ডিপ্লোমেসির প্রসঙ্গটা টেনে আনার কারণটা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন আছে বৈকি। বাংলাদেশের জন্য পিংপং ডিপ্লোমেসির রূঢ় বাস্তবতা আরও বহু লাখ বাঙালি শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলার সবুজ প্রান্তর। অন্যদিকে সে সময়ের বৈশি^ক রাজনৈতিক বাস্তবতায় কিসিঞ্জারের এই ঝটিকা ইসলামাবাদ সফরটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, একে আজও কূটনীতির ছাত্র আর ডিপ্লোমেটরা পিংপং ডিপ্লোমেসির নামেই মনে রেখেছে।
সম্প্রতি একটি সেলফি আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ঝড় তুলেছে। দল-মত নির্বিশেষে ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট আছে, আর এই সেলফিটি শেয়ার করেননি এমন বাঙালি খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে বাঙালির সোশ্যাল মিডিয়ার বিশাল গণ্ডি পেরিয়েও সেলফিটি জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ব মিডিয়ায় এবং ডিপ্লোমেটিক সার্কিটেও। একে বলা হচ্ছে ‘সেলফি ডিপ্লোমেসি’। নয়া দিল্লিতে সদ্য সমাপ্ত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর যে ১৫ মিনিটের অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ, সেখানে আলোচিত এই সেলফিটির তিনজন ছাড়াও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

অগত্যা সেলফিটির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে ভারতের জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, সে দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী মিডিয়ার সামনে এটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মন্তব্যে উঠে এসেছে বডি ল্যাঙ্গুয়েজের বিষয়টি। বিষয়টি আসলেও তাই। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই সেলফিটি যে কতটা গুরুত্ববহ, তা সেলফিটিকে কেন্দ্র করে এদেশীয় কিছু রাজনীতিবিদের পাগলের প্রলাপসম বিলাপের মধ্যেই সুস্পষ্ট। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব সম্ভবত আরও অনেক। আমরা কূটনীতির ছাত্র নই। অতএব, কূটনৈতিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা কিংবা এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করা আমাদের পরিধির বাইরে।

তবে বিষয়টি এবং এর সম্ভাব্য ক্রিয়া-বিক্রিয়াগুলো এতটাই প্রবল যে, সামনের দিনগুলোতে এই একটি সেলফি দেশের মানচিত্রের সীমানা পেরিয়ে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মেরুকরণেও যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে, তা বোঝার জন্য বোধকরি অতশত কূটনীতি বোঝা আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
তবে একটা বিষয়েও আমি দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই প্রধান নেতার সঙ্গে একমত। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্তব্য করেছেন যে, এই একটি সেলফিতেই বিরোধী দলের ধরাশায়ী দশা। তার এই মন্তব্যের সঙ্গে শুধু আমি কেন, আমার মনে হয় বিএনপি সমর্থকরাও একমত পোষণ করবে। অন্যদিকে, বিএনপির মহাসচিব আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে সেলফিটি গলায় ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমি তার সঙ্গেও একমত। তবে এক ডিগ্রি আগ বাড়িয়ে আমার মনে হয় যে, শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থকরাই নন, সেলফিটি গলায় না হলেও অন্তরে ধারণ করা উচিত মির্জা ফখরুলসহ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকেরই। কারণ, হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশকে ‘একজন শেখ হাসিনা’ যে আজ বিশ্বে কোন্ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তা বোঝার জন্য বোধকরি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির অতি আগ্রহে তোলা এই একটি সেলফিই যথেষ্ট!