বাকৃবির তিন ভিসি: লিখেছেন ইফতু আহমেদ

বাকৃবির তিন ভিসি

ইফতু আহমেদ  (অরোরা, ইলিনয়ইউএসএ)  

মানব জীবনের পাঁচটি ইন্দ্রিয়শক্তি দর্শন, শ্রবণ, স্বাদ, স্পর্শ ও গন্ধ মানবজীবনকে সার্থক পর্যায় উপনীত হতে সহায়ক করে। এর এক বা একাধিক ঘাটতি হলে মানুষ দুর্বিষহ প্রতিবন্ধীতার পর্যায় পড়ে I যাঁরা এর ভুক্তভোগী, তাঁরাই এর উপলদ্ধি করতে পারে। শ্রবণ, বক্তৃতা এবং সংগীতের আনন্দ হ’ল মানব যোগাযোগ এবং অভিব্যক্তির তিনটি কেন্দ্রীয়রূপ ও আশীর্বাদস্বরূপ। তা সত্ত্বেও ইন্দ্রিয় শক্তির ঘাটতিমান মানুষ আজ বসে নেই, সারা বিশ্বে তাঁরাও ঈশ্বরের ভালবাসায় প্রতিবন্ধিকতার সাথে সংগ্রাম করছে এবং সার্থক হয়েছে অনেকই সুদূরপ্রসারী ভাবেই।

চারিদিকে সবুজের সমারোহ, গাছপালার ছায়া ঢাকা, ফুলের গন্ধে সুবাসিত, পাখির কলরবে মুখরিত এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)| ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত আমার ২০ বছর জীবনের সুতিকাগার। আমেরিকায় আগমনের পূর্বে আমার শিক্ষা, ক্রীড়া ও লেখনীর জীবনের সূত্রপাত ঘটে বাকৃবির পুন্যভুমিতে।

আমার জীবনকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জীবন। সে নিরিখে ৩০ বছর কাটিয়েছি জন্মভূমি বাংলাদেশে এবং বাকী ৩৫ বছরের অধিক চলছে এই মার্কিন মুল্লুকে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানান অভিজ্ঞতার মিলনসেতু হয়েছি আমি। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস নই, তবে ইতিহাসের উপর পড়াশুনা করেছি। তাই হেরোডোটাসের মত কালের স্বাক্ষী হয়ে পারিপার্শ্বিক জীবন অভিজ্ঞতা লিখছি।

স্কুল থেকে ফিরেই খেয়ে দেয়ে ছুট দিতাম ওপারের কলোনীতে বাল্যবন্ধু এরশাদের বাসার বাম দিকের নদীর পাড়ের সংলগ্ন খেলার মাঠে। সেখানে আমরা ক্যাম্পাসের ছেলেপুলের দল খেলতাম ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি এবং করতাম প্যারেড প্রতিদিনকার মত। সেখানে বিকাল বেলায় প্রায়ই দেখতাম মরহুম প্রফেসর কাজী ফজলুর রহীম চাচাকে। তিনি তখন সম্ভবতঃ ফ্যাকাল্টির ডীন ছিলেন। নদীর পাড়ে তখন তিনি ইভেনিং ওয়াক করতেন একাকী, কখনওবা সহকর্মীদের সাথে। আমরা তখন খেলায় মশগুল থাকতাম, ফাঁকে ফাঁকে দেখতাম রহীম চাচাকে সেই ছোটবেলার দিনগুলিতে।

রহীম চাচা ছিলেন দেশের একজন দেশপ্রেমিক উপাচার্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাওয়ার পরে, তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চে প্রশাসনিক ভবন চত্বরে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি “স্বাধীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়” নামে পরিচিত হবে যা ইংরেজিতে “Independent Bangladesh Agricultural University।”

রহীম চাচা এবং কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রয়াত প্রফেসর ডঃ শামসুল ইসলাম চাচা দু’জনই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার তমঘা-ই-কায়েদ-আজম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন।

ব্যক্তিগতভাবে র্রহীম চাচা আমার পরিচিত ছিলেন। আজকের এই জীবন সায়াহ্নের বয়সে আমি তাঁর সোনার স্মৃতিগুলি লালন করি। তাঁর সেরা স্মৃতিগুলির একটি অন্যতম স্মৃতি হলো আমি তখন আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বার্ষিক এথলেটিক্স ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম এবং তিনি ছিলেন আমাদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রধান অতিথি। ক্রীড়া শেষে রহীম চাচা আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি তোমাকে তোমাদের বাসায় পৌছিয়ে দিব।” অতঃপর আমি তাঁর নীল রংয়ের মার্সিডিজ গাড়িতে তাঁর পাশে বসে বাকৃবির বাসায় ফিরেছিলাম।

রাইডিংকালে আমি তাঁকে বাকৃবির ক্যাম্পাসের আমাদের খেলার মাঠ সমতল করার কথা বলেছিলাম। কিছু দিন পরে, আমি লক্ষ্য করি বাকৃবির  প্রকল্প অফিসের কর্মীরা আমাদের খেলার মাঠ সমতল করতে আসে। তিনি এমন সুন্দর শ্রোতা ছিলেন। এছাড়াও তিনি আমাদের ক্যাম্পাসের ছেলে-মেয়েদের  জন্য ক্যাম্পাসের চারপাশে সুইং সেট স্থাপন করেছিলেন। আমাদের ক্যাম্পাসের ছেলেদের অ্যাথলেটিক স্বপ্ন পূরণের জন্য ধূমকেতু  ক্লাব এবং সবুজ মেলা ক্যাম্পাসে গড়ে উঠে। আমি আমাদের বাকৃবি ক্যাম্পাস থেকে জুনিয়র ফুটবল এবং বাস্কেটবল লীগের মত যুব ক্রীড়া কার্যক্রমের আয়োজন করি এবং জাতীয় দৈনিক বাংলা পত্রিকা, দৈনিক ইত্তেফাকে ক্যাম্পাসের ক্রীড়া কাহিনী ছবিসহ প্রকাশ করি। এগুলি সবই সম্ভব হয়েছিল রহীম চাচার মত  দয়ালু মনের বিশালতায়।

রহীম চাচার একমাত্র কন্যা ফৌজিয়া আপা আমার বহু আগে থেকেই আমেরিকায় নিবাসী। রহীম চাচার পরবর্তী বাকৃবির উপাচার্য ছিলেন ছাত্রপ্রিয়, জনপ্রিয়, অমায়িক ও পরোপকারী মরহুম উপাচার্য প্রফেসর মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী চাচা। তিনি বাকৃবির ক্যাম্পাসের অনেকেরই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। সে নিরিখে তিনি ছিলেন বাকৃবির পৃথিবীর একান্ত আপনজন ও পরম সুহৃদ।

বাকৃবির ক্যাম্পাসে যখন আমি ধূমকেতু ক্লাবের ফুটবল খেলা পরিচালনা করতাম রেফারিং এর ভূমিকায়, তখন চৌধুরী চাচা সব সময় প্রধান অতিথি হয়ে আসতেন। সে খেলায় নুরুল ইসলাম নামক গোলরক্ষকের অসাধারণ নৈপুণ্যে বিমুগ্ধ হয়ে চৌধুরী চাচা শুধু গোল্ড মেডেল দেননি, অধিকন্ত বাকৃবিতে তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এমন প্রাণের মানুষ ছিলেন তিনি। ইত্তেফাকে চাচার ছবিসহ এর খেলার বিবরণী প্রকাশ করেছি। চাচা ছিলেন এমন জনপ্রিয় মানুষ যে, তাঁর বিদায় কালে বাকৃবি থেকে ময়মনসিংহ রেল স্টেশন পর্যন্ত নেমেছিল জনতার ঢল।

চৌধুরী চাচা বাকৃবির ক্রীড়া ও সংস্কৃতির জগতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছিলেন। উনার সময় বাকৃবির খেলোয়াড়দের সম্মানার্থে এক বিশাল ব্লেজার প্রদানের অনুষ্ঠান হয় I

ধূমকেতু ক্লাবের বিভিন্ন খেলাধূলা পরিচালনা করতে গিয়ে যার সাহায্য ও দরাজ প্রাণের সাড়া পেতাম, তিনি ধূমকেতু ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা, সদ্য সহধর্মিনী বিয়োগ, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ও চিকিৎসক ডাঃ কামরুল হাসান লালী ও তার ছোট ভাই অস্ট্রেলিয়া নিবাসী নাজমুল হাসান আনজু। উল্লেখ্য, ধূমকেতু ক্লাব সম্ভবতঃ বাংলাদেশে প্রথম “জুনিয়র বাস্কেটবল লীগ” অয়োজন করে এবং ইত্তেফাকে এর ছবিসহ ক্রীড়াকাহিনী প্রকাশ করেছিলাম।

ধূমকেতু ক্লাবের ফুটবল রেফারিং অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে আমেরিকায় আমার প্রারম্ভিক ছাত্র জীবনে কাজে লেগেছিল। আমেরিকায় আমার প্রথম জব ছিল সকার রেফারী ও  অফিসিয়াল  তা পার্ক ডিস্ট্রিক্ট ও ওয়াইএমসির অধীনে। আমেরিকার পার্ক ডিস্ট্রিকের এথলেটিক প্রোগ্রাম সুপারভাইজর ফ্রান স্টালটার আমার সম্পর্কে লিখেছিলেন: “As a soccer referee, Iftu Ahmed is always reliable. His eagerness and knowledge of the rules over-shadow his hearing disability, as Iftu Ahmed has no problems communicating his calls on the field.”অর্থাৎ “সকার রেফারী হিসাবে ইফতু আহমেদ ছিলেন সবসময় নির্ভরযোগ্য। তাঁর উৎসুক্যতা এবং ফুটবলের নীতিমালার উপর জ্ঞান তাঁর শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা ঢেকে দিয়েছিল যা কোন সমস্যা ছিল না মাঠে খেলোয়াড়দের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারে।”

ফেসবুকে তসলিমা চাচীর সাথে যোগাযোগ আছে। ক্যাম্পাসে বাপ্পীর সাথে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল ও মজার মজার ক্রিকেট গল্প করতো আমার সাথে। ছোটভাই আন্দালিবের প্রাণের সাড়া দেখি ফেসবুকে। ওরা সবাই আমার মত আমেরিকা নিবাসী, সেখানে চাচী যাওয়া-আসা করেন। `

চৌধুরী চাচার পর যিনি বাকৃবির ভিসি হয়েছিলেন, তিনি প্রফেসর ডঃ এ.কে.এম. আমিনুল হক চাচা। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও মৎস্য শিক্ষার জনক। তিনি বাকৃবির দুই মেয়াদী ভিসি ছিলেন।

ক্যাম্পাসে উনাকে দেখতাম পুকুর ও নদীতে নামতেন মৎস্য শিক্ষার গবেষণায়।

সবে মাত্র এম.এ. পাশ করে বের হয়েছি। বাকৃবির ক্যাম্পাসের মসজিদ নবীজি হজরত মুহাম্মদ (সঃ) এর মিরাজ সম্পর্কে একটা আলোচনার সভা আয়োজন করেছিল। হক চাচা সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন। মিরাজ সম্পর্কে মসজিদে বক্তৃতা করছিলাম। আমার বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর হক চাচা আমার সম্পর্কে কি যেন বলছিলেন? কানে খাটো বিধায় বুঝে উঠতে পারেনি। এর কিছুকাল পর আব্বা এসে বললেন, “ভিসি সাহেব তোমাকে বাংলাদেশ তৃতীয় কোরানিক সম্মেলনে ক্যাম্পাসের ডেলিগেট হয়ে ঢাকায় পাঠাতে চান। তোমাকে টিএ এবং ডিএ সব কিছুই দিবেন।” আমি সানন্দে রাজী হয়েছিলাম এবং বাংলাদেশ তৃতীয়  কোরানিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ভিসি সাহেবকে  সালাম জানাই, আমার মত একজন শ্রবণবন্দী মানুষকেও তিনি সম্মানিত করেছিলেন। আমীন! এখানে আমেরিকায় একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল I আমরা তখন ৮/১০ জন হবে ওয়ালমার্ট থেকে ভলন্টিয়ার করতে Northern Illinois Food Bank (NIFB)) এ গিয়েছিলাম। এটা একটি স্বল্প আয় মানুষদের যেমনঃ সিনিয়র, ডিজাবেল্ড ইত্যাদি ফুড দিয়ে সাহায্য করার প্রতিষ্ঠান। সেখানে আমাকে দেখে NIFB এর ম্যানেজার তাজ্জব কি বাত! ডেফ মানুষও যে ভলন্টিয়ার করে এটা তাঁর জানা ছিল না I তাই তিনি সভায় আমার ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলেন, আমাকে ওঁদের একটি মনোগ্রাম খচিত টি-সার্ট দিয়ে সম্মানিত করলেন। ইনারপ্রিটার না থাকতেই বিষয়টি আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। পরে লিখে আমাকে বুঝানো হলো। হক চাচার সভায় আমারও এমন অবস্থা হয়েছিল। মসজিদে কেউ লিখে বিষয়টি আমাকে পরিষ্কার করেননি।

হক চাচা খুশী হতেন, যদি জানতেন আমরা ২০১৫ সালে সস্ত্রীক আমেরিকা থেকে পবিত্র হজ্ব পালন করেছি।

হক চাচার বড় ছেলে জুনাইদ আমেরিকায় সস্ত্রীক এক বেবী কন্যাসহ আমাদের বাসায় এসেছিল, তখনকার দিনের ইলিনয় নিবাসী ডঃ আমজাদ হোসেনের সাথে এবং তিনি হক চাচার ছাত্র ছিলেন।

জুনাইদের কাছে জেনেছিলাম বাংলাদেশে ও গোল্ড মেডেলিস্ট, পড়াশুনায় চাচার মতই মেধাবী। বাকৃবির ক্যাম্পাসে ও “অন্বয়” নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিল, দেখলাম ও আমার ইতিহাসভিত্তিক লেখা ওর ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশ করেছে। সে থেকে ওকে খুব ভাল লাগতো। এটা বোধ করি ২০ বছর আগের কথা, জুনাইদকে আমেরিকায় দেখেছিলাম। ও বলেছিল ফ্লোরিডাতে থাকবে। তারপর জুনাইদের কোন খবরাখবর নেই। ওর ফেসবুক ঠিকানা পেতাম, খুবই বাধিত হতাম।

পরিশেষে এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় কেউতো চিরকাল থাকে না, থাকে শুধু স্মৃতিচারণ। রহিম চাচা ও আহমেদ চাচার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি, জান্নাতুল ফেরদৌসের প্রার্থনা করি। আমীন! হক চাচার অনন্ত শান্তির দোয়া রইলো। আমীন!

তারিখঃ ১১/১২/২০