বিএসএমএমইউয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রত্যাশা: ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
আজ ৩০ এপ্রিল। কালের পরিক্রমায় ২৩ বছর পার করে ২৪ বছরে পা দিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। ১৯৯৮ সালের এই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সেদিনের আওয়ামী লীগ সরকার তৎকালীন আইপিজিএমআরকে দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেছিলেন। শিক্ষা, গবেষণা আর চিকিৎসা—এই তিন প্রতিপাদ্য আর জাতির জনকের নাম ধারণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিএসএমএমইউ। লক্ষ্য ছিল জাতির স্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত এই তিনটি মূল জায়গায় দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া আর দেশের সীমানা পেরিয়ে দেশের বাইরে বিদেশে স্বাস্থ্য খাতে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। সেই আস্থার জায়গাটি থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতির জনকের নাম দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। সঙ্গে সম্মানিত করেছিলেন চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশাকেও। কারণ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নাম ধারণ করে গৌরবান্বিত হয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হাতে গোনা, আর সেই গুটিকয়েক নামের ভিড়ে জ্বলজ্বলে নামটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার সৌভাগ্য চিকিৎসক হিসেবে ক্যারিয়ারের একটা বড় অংশ কেটেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন অনারারি চিকিৎসক, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের ছাত্র আর তারপর সহকারী থেকে পূর্ণ অধ্যাপক, এমনকি বিভাগীয় প্রধানের তকমাও আমার জুটেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণেই। বিএসএমএমইউয়ের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের সাক্ষী আমি। আমার চোখের সামনে দিয়েই এই প্রতিষ্ঠানের বিকাশ আর বড় হয়ে ওঠা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদে ধন্য। এ কারণেই প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আজ পর্যন্ত যাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেককেই পেশাগত দক্ষতা আর আদর্শিক দৃঢ়তার কারণেই পুরো পেশা থেকে বাছাই করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। আর ঠিক সেই কারণেই আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে, বিএসএমএমইউয়ের প্রতি খড়্গহস্ত ছিল তৎকালীন সরকার চরম নির্মমতায়। বিএসএমএমইউয়ে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর শ্বেত ম্যুরালটি শুধু হাতুড়ি-বাটালের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে আর কালো কালিতে লেপেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, পুরো কাঠামোটি ঢেকে দেওয়া হয়েছিল পুরু প্লাস্টারের আচ্ছাদনে আর এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামাঙ্কিত প্রতিটি প্রস্তরফলকে তাঁর নামটা নির্লজ্জভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল কালো কালিতে।
আমার দৃষ্টিতে দেখা বিএসএমএমইউয়ে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি স্বাধীনতার সপক্ষীয় প্রশাসনই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ভালোভাবে বুঝে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আরেকটু সামনে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট থেকেছে। তাদের অভিযাত্রায় সাফল্য আর ব্যর্থতা থাকতেই পারে, তবে চেষ্টায় ত্রুটি ছিল বলে মনে হয়নি। তারা চেষ্টা করেছিল তিনটি মূল লক্ষ্যের ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিনির্মাণে। এ দেশের অভিজাত সম্প্রদায় তো বটেই, এমনকি সরকারি হাসপাতালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মধ্যবিত্তকেও সরকারি হাসপাতালমুখী করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যে বটতলায় একসময় ছিল নেশার স্বর্গরাজ্য কিংবা এই ক্যাম্পাসে ট্রেনিং করার সময় এক ব্লক থেকে সাঁঝের ‘ঘুটঘুটে আঁধারে’ আরেক ব্লকে যেতে আমাদের মতো পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনরত চিকিৎসকদের হতো থরহরি কম্প, অভিজাত, উচ্চপদস্থ আর মধ্যবিত্তের পদচারণে মুখর আজকের বিএসএমএমইউ ক্যাম্পাসে আজ তাদের গাড়ির চাপে চিকিৎসকদের গাড়ির পার্কিংয়ে ঠাঁই পাওয়া দায়। আর বিএসএমএমইউয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যতম লক্ষ্য ‘চিকিৎসায়’ এই বরেণ্য প্রতিষ্ঠানটিকে দেশবরেণ্য করে তোলায় যাঁর অবদান আমার নির্মোহ দৃষ্টিতে সর্বাগ্রে, তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। পাশাপাশি এই সাবেক উপাচার্য আমাদের পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল কারিকুলামে রেসিডেন্সি প্রগ্রামে পুনঃপ্রবর্তনের জন্যও বরণীয় হয়ে থাকবেন।
সেই ধারাবাহিকতায় সেই অর্জনগুলো ধরে রেখে একটি ইনস্টিটিউটকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের পথিকৃৎ ছিলেন বিএসএমএমইউয়ের আরেক সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার বিকাশ, সৃজনশীলতার চর্চা আর বিএসএমএমইউয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘গবেষণায়’ প্রণোদনা দেওয়ার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ল্যাব আর ক্লিনিক্যাল স্থাপনা তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণে রাখবে। অধ্যাপক কামরুল হাসান খানের মেয়াদকালে এই ক্যাম্পাসে যেমন বৈশাখবরণ হয়েছে, উঠেছে টিএসসিতে চায়ের কাপে আড্ডার ঝড়, তেমনি হতে দেখেছি বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনও। তাঁর অবারিত প্রশ্রয়েই এ দেশে প্রথমবারের মতো লিভার সিরোসিস রোগীদের চিকিৎসায় অটোলোগাস হেমোপয়েটিক স্টেমসেল ট্রান্সপ্লান্টেশন আর লিভার ফেইলিওরে লিভার ডায়ালিসিস করার সুযোগ হয়েছিল আমার এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই। আমার মতো এমন সুযোগ পেয়েছিলেন আরো অনেকেই আর সে কারণেই সেই সময়ে দিল্লির অল ইন্ডিয়া অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস আর করাচির আগা খান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে বিএসএমএমইউ প্রথমবারের মতো স্থান করে নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব র্যাংকিংয়ের সম্মানজনক জায়গায়।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন একজন নতুন উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ। সকালের সূর্য যদি বাকি দিনটুকুর পূর্বাভাস দেয়, তবে তার অল্প কদিনে আমার ধারণা, তাঁর মেয়াদান্তে গবেষণার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আরেকটু বেশি এগিয়ে থাকবে। কারণ আজ অমুক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল তো কাল রিসার্চ সেলের তৎপরতা ইত্যাকার বিষয়ে তাঁর প্রাত্যহিক তদারকিতে আমার মতো আরো অনেক বিএসএমএমইউ শিক্ষকেরই কভিডকালীন নিস্তরঙ্গ সকাল-দুপুর এখন ভাটার বদলে জোয়ারে সয়লাব।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রথাগত লেখনী এটি নয়। এমন দিবসে লেখাগুলোয় প্রথাগতভাবে থাকার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ আর সাফল্যের বিস্তারিত বয়ান। এই লেখাটি যাদের নজরে আসবে লেখাটির শুরুতে তাদের প্রত্যাশাও সম্ভবত থাকবে তেমনটাই। আমি অবশ্য তেমনটা চাইনি। চাইনি প্রথাগত আরেকটি লেখা লিখে লেখার ভিড় বাড়াতে। সেটি আমার কাজ নয়। এ জন্য আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর। তেমনিভাবে কোনো বিশেষ ব্যক্তিবন্দনাও আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। লেখাটি লিখতে বসে আমার কাছে মনে হয়েছে আমি অত্যন্ত নির্মোহভাবে ওই মানুষগুলোর কথা তুলে ধরব, যাঁরা ভালোদের ভেতরেও আরো ভালো বলেই জাতির পিতার নামধারী এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাছাইকৃত হয়েছিলেন এবং যাঁরা আমার মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের দৃষ্টিতে তাঁদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বটুকু পালনে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি কিংবা রাখছেন না। এমনি আরো কিছু যোগ্যর মধ্যেও যোগ্যতর ব্যক্তিদের অনাগত নেতৃত্বে এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিন সত্যি সত্যি বিশ্ব র্যাংকিংয়ে শীর্ষে এসে আমাদের গর্বিত করবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অবশিষ্ট মেয়াদকালে আমি যেন তা দেখে যেতে পারি, বিএসএমএমইউয়ের এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমার এটুকুই প্রত্যাশা।
৩০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০