ময়মনসিংহের অক্সিজেনের ফেরীওয়ালা ‘আলী ইউসূফ’

ময়মনসিংহ অঞ্চলে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ার পাশপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। তারপরও মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবনতা দেখা যায় না। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে বা করোনায় মারা যাওয়া কোন পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা দিতে লোকের সংখ্যা খুব কম।

এই সংকট সময়ে ময়মনসিংহ নগরীতে করোনা রোগীর ও করোনা আক্রান্ত পরিবারের ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছেন ময়মনসিংহ নগরীর এক স্বেচ্ছাসেবক আলী ইউসুফ। ব্যাক্তি জীবনে তিনি একজন প্রেস ব্যবসায়ী। নগরীর ছোট বাজার এলাকায় তাঁর একটি প্রেস রয়েছে, এক সময় সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। এখন ব্যবসার পাশপাশি এই প্রেসই এখন ‘অক্সিজেন সেবা কেন্দ্র’।

নগরীর যেখানেই করোনা রোগী শ্বাসকষ্টে ভুগছে সেখানে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হাজির হচ্ছেন আলী ইউসুফ। ‘অক্সিজেনের ফেরীওয়ালা’ নামেও তিনি এখন শহরে পরিচিতি লাভ করেছেন। গত বছর যখন মহা আতঙ্ক নিয়ে করোনা মহামারীর সংক্রমণ শুরু হয় তখন থেকেই বিভিন্নভাবে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আলী ইউসুফ। তাঁর সাথে আছে তরুণ প্রজন্মের একটি স্বেচ্ছসেবক দল।

করোনা রোগীর সেবা দেয়া, করোনা আক্রান্ত অসচ্ছল পবিারকে খাদ্য সাহায্যসহ করোনা প্রতিরোধক সামগ্রী সরবরাহ করা, এমনকি করোনায় মৃত লাশের সৎকার করা, হোক মুসলিম বা যেকোন ধর্মের- সবই এখন করছেন তারা। করোনা শুরুর দিকে যখন করোনায় কেউ মারা যেত তখন মৃত ব্যাক্তির লাশের কাছে পর্যন্ত কেউ যেত না তখন এই আলী ইউসুফ তার সেই দল নিয়ে লাশের দাফন কাফনসহ সব ধরনের সহযোগিতা ওই পরিবারকে দিয়ে যান। এ কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে।

দিন আর রাত নেই যখনই খবর আসছে কেউ মারা গেছে, কারো অক্সিজেন লাগবে, হাসপাতাল নিতে কারো অ্যাম্বুলেন্স লাগবে আলী ইউসূফ তার দল নিয়ে এসব সেবা দিতে হাজির হয়ে যান।

একদিন রাত তিনটায় মোবাইল ফোন বেজে উঠলো আলী ইউসুফের। ফোন ধরতেই, ওপার থেকে একজন বলছেন, আলী ইউসুফ! ভাই, আমার চাচা হাসপাতালে মারা গেছেন, ওনার করোনা ছিল। আমাকে একটু সাহায্য করবেন, লাশ দাফন করতে আমার আত্বীয়রা কেউ আসতে সাহস পাচ্ছে না। আলী ইউসুফ উত্তর দিলেন আমি আসছি হাসপাতালে আপনি থাকেন। আলী ইউসুফ জানালেন, এ ধরনের ফোনে আমি এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

আলী ইউসুফ তাঁর দল নিয়ে এখন পর্যন্ত ৫০ টির অধিক করোনায় মৃত লাশের দাফনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। হিন্দু ধর্মের মানুষের লাশ সৎকারেও সহযোগিতা করেছেন। ময়মনসিংহ নগরীতে প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনের তিনটি দল করোনায় মৃত লাশের সৎকার করে থাকে। তার মধ্যে দুটি দলের নেতৃত্ব দেন এই আলী ইউসুফ। শুধু তাই নয় করোনাকালে নিন্ম আয়ের ও চাকুরী হারানো পরিবারের দ্বারে দ্বারে খাদ্য সামগ্রীসহ সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে হাজির হচ্ছেন আলী ইউসুফ।

এ কাজে সমাজের কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ আলী ইউসুফকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। কেউ অক্সিজেন সিলিন্ডিার দিয়ে, কেউ নগদ অর্থ দিয়ে, কেউ খাদ্য সামগ্রী দিয়ে, আবার শীতের সময় অনেকেই শীত বস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আবার কিছু তরুণ স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করছেন তার সাথে।

আলী ইউসুফের কাছে এখন অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ৪২টি। আলী ইউসুফ বলেন, বর্তমানে ময়মনসিংহে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে। একজনকে সিলিন্ডার দেয়ার পর কমপক্ষে ৭ দিন সেখান থেকে সিলিন্ডার ফেরৎ পাওয়া যায় না। কোন এক সময় সিলিন্ডার শেষ হযে যায়। আর যখন সিলিন্ডার হাতে থাকে না তখন মনে হয় আমার নিজেরই অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। কেউ এখন ফোন করলে কি বলবো? অক্সিজেন সিলিন্ডারের আরো প্রয়োজন বলে জানালেন তিনি।

এই স্বেচ্ছাসেবক আলী ইউসুফ শুধু করোনাকালেই সেবা দান করছেন তা না, তিনি এখন পর্যন্ত নিজে রক্ত দিয়ে মুমূর্ষ রোগীর জীবন বাঁচাতে ৫৪ বার রক্ত দিয়েছেন। তাঁর সাথে থেকে থেকে তাঁর সহধর্মিনীও হয়ে উঠেছেন সেবাব্রতী। তিনিও এ পর্যন্ত রক্ত দিয়েছেন ৮ বার। এছাড়াও যখনই ময়মনসিংহ হাসপাতালে বা নগরীর যেকোন হাসপাতালে কোন রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলে ডাক পড়ে আলী ইউসুফের। সে নিজে দেয়ার সময় না হলে বা রক্তের গ্রুপ না মিললে তার দলের যে কারো সাথে গ্রুপ মিললে বা ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে ডোনার সংগ্রহ করে রক্ত দিতে হাজির হয়ে যান তিনি।