দূর হোক ক্যান্সার চিকিৎসার সকল অন্তরায়: অধ্যাপক ডাঃ কাজী মুশতাক হোসেন

লেখকঃ অধ্যাপক ডাঃ কাজী মুশতাক হোসেন
বিভাগীয় প্রধান, রেডিওথেরাপী বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ। সাবেক পরিচালক – জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল।
ক্যান্সার মিথঃ
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে আমরা ক্যান্সার সম্পর্কে অনেকে অনেক কিছু জানি কিন্তু আমাদের জানা সব তথ্যই কি সঠিক? না বরং আমরা অনেক ভুল তথ্য পাই আর তা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে এবং ভুল পথে পরিচালিত করে। এখানে আমরা ক্যানসার সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল ধারনা সম্পর্কে আলোচনা করব। এ ব্যাপারে আপনি আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলে আরও বিশদ ধারনা পেতে পারেন।এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ক্যান্সার মিথ বা ভুল ধারনা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসুন।
মিথ – ক্যান্সার ছোঁয়াচে রোগ-
প্রকৃত তথ্য- ক্যান্সার ছোঁয়াচে রোগ নয়। তবে কিছু কিছু ক্যান্সার ভাইরাস সংক্রমণের মাধ্যমে হয়, সেগুলোকে ছোঁয়াচে বলা যেতে পারে। ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারলে এ ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
মিথ – পরিবারের কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত না হলে আপনার ক্যান্সার হবে না-
প্রকৃত তথ্য – মাত্র ৫-১০% ক্যান্সার বংশগত। বেশীর ভাগ ক্যান্সার জিন মিউটেশনের ফলে হয়। বিকিরন, তামাক এবং কিছু রাসায়নিক পদার্থ এর জন্য দায়ী। তাই আমরা সকলেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছি।
মিথ – পরিবারের কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে আপনারও ক্যান্সার হবে এবং এটা ঠেকানো যাবে না-
প্রকৃত তথ্য – পরিবারের কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে আপনারও ক্যান্সার হতে পারে কিন্তু হবেই এমন নয়। আপনার ঝুঁকি কিছুটা বেশী হলেও এটা কোন নিশ্চয়তা দেয় না। বরং কিছু নিয়ম মেনে চললে বেশীর ভাগ ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন পরিমিত খাদ্য গ্রহন, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রন, ব্যায়াম করা, ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকলে অনেক রকমের ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। এমন কি পারিবারিক ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকলে আগাম চিকিৎসা গ্রহন করে সেই সব ক্যান্সারকেও প্রতিরোধ করা যায়।
মিথ – চুলে ব্যবহার করা রঙ বা দুর্গন্ধ নাশক বা ঘাম প্রতিরোধক ব্যবহার করলে ক্যান্সার হতে পারে-
প্রকৃত তথ্য – এটাও সঠিক নয়। এ ব্যাপারে প্রমানিত কোন তথ্য নাই। ১৯৮০ সাল নাগাদ এরকম একটা ধারনা করা হয়েছিল যে চুলের রঙ বা দুর্গন্ধ নাশক ব্যাবহার করলে ‘নন-হজকিন্স লিম্ফোমা’ হতে পারে। এর পর পরই সন্দেহ জনক সে সব রাসায়নিক পদার্থ ব্যাবহার বন্ধ করে দেয়া হয়।
মিথ – ক্যান্সার হয়েছে এটা না জানাই ভাল বা ডাক্তারের কাছে না যাওয়াই ভাল-
প্রকৃত তথ্য – ক্যান্সার হয়েছে শুনলে যে কেউই ভীত হয়ে পরে কিন্তু তাই বলে সন্দেহ হলে ঘরে বসে থাকা উচিত নয়। কেননা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেই আপনি চিকিৎসার সুযোগ পেতে পারেন। গুরুত্ত্ব পূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করলে অনেক ধরনের ক্যান্সার সম্পূর্ণ ভাবে সেরে যায়।
মিথ – নিডল বায়প্সী করালে ক্যান্সার শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পরে-
প্রকৃত তথ্য – ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, এর ফলে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার কোন প্রমান নেই। এ ব্যাপারে ডাক্তার সচেতন থাকেন। শুধুমাত্র টেস্টিস এর ক্ষেত্রে এটি করানো হয় না।
মিথ – ইতিবাচক চিন্তা করলে ক্যান্সার ভাল হয়ে যায়-
প্রকৃত তথ্য – ইতিবাচক চিন্তা অবশ্যই ভাল কিন্তু এর ফলে ক্যান্সার ভাল হয় এমন কোন প্রমান নেই। বরং রোগ অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকলে এটা আপনাকে অপরাধ বোধে আক্রান্ত করতে পারে বা ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।
মিথ – চিনি খাওয়া বাদ দিলে ক্যান্সার ভাল হয় বা ছড়ায় না-
প্রকৃত তথ্য – এমন কোন প্রমান নেই যে চিনি ক্যান্সার ঘটায় বা চিনি বর্জন করলে ক্যান্সার ভাল হয়। শরীরের অন্য কোষগুলোর মতোই ক্যান্সার কোষ চিনি গ্রহন করে। তবে অতিরিক্ত চিনি বা শর্করা গ্রহন স্বাস্থ্যের জন্য ভাল নয়।
মিথ – ক্যান্সার ধরা পড়লে মৃত্যু অবধারিত-
প্রকৃত তথ্য – ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে অনেক রকমের ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব।
মিথ – ক্যান্সার মানেই তীব্র ব্যাথায় কষ্ট পাওয়া-
প্রকৃত তথ্য – সঠিক নয়। শুরুতে বরং ব্যাথা হয় না বললেই চলে। আর বলা যায় শতকরা ৯৫ ভাগ ব্যাথা চিকিৎসার সাহায্যে কমানো যায়।
মিথ – বয়স্ক ব্যক্তির চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়-
প্রকৃত তথ্য – ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বয়সের কোন সীমা নাই। বয়স্ক ব্যক্তিরাও চিকিৎসা করলে অল্প বয়সীদের মতোই ফল পেতে পারেন। তবে তাদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ওষুধের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। যদি অন্য কোন অসুখ থাকে তাহলে সেটা বিবেচনা করেই ওষুধ নির্বাচন করা হয়।
মিথ – ক্যান্সার রোগের চেয়ে এর চিকিৎসা আরও খারাপ-
প্রকৃত তথ্য – ক্যান্সার চিকিৎসার কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কিন্তু সেটা ক্যান্সারের চেয়ে খারাপ নয়, এসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ারও চিকিৎসা আছে। বর্তমানে যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। রেডিওথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানোর জন্যও ব্যবস্থা রয়েছে।
মিথ – ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা কালীন সময়ে কোন কাজ কর্ম করতে পারে না-
প্রকৃত তথ্য – চিকিৎসা কালীন সময়ে ব্যক্তিগত বা ঘরের বা সামাজিক কাজ সবই করা যায়। কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নেবার জন্য দীর্ঘদিন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি থাকতে হয় না।
মিথ – প্রত্যেক ক্যান্সার রোগীরই চিকিৎসা করা প্রয়োজন-
প্রকৃত তথ্য – কোন কোন ক্ষেত্রে চিকিৎসা না নিয়ে পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়, রোগ বৃদ্ধি পেলে চিকিৎসা নিতে হয়। আবার রোগের অত্যন্ত বৃদ্ধি পর্যায়ে কোন সক্রিয় চিকিৎসা না দিয়ে কষ্ট লাঘবের জন্য ব্যবস্থা নিতে হয়।
মিথ – নিয়মিত চেক আপ করলে সব ক্যান্সার সূচনাতেই ধরা পরে-
প্রকৃত তথ্য – সব ধরনের ক্যান্সার সনাক্ত করার জন্য স্ক্রিনিং টেস্ট নাই। জরায়ু, স্তন এবং অন্ত্রের ক্যান্সার স্ক্রিনিং করে সহজেই সূচনাতে নির্ণয় করা যায় এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া যায় বা রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পরে।
মিথ – ওষুধ কোম্পানি বা চিকিৎসক অনেক সময় নতুন ওষুধ আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করে না।
প্রকৃত তথ্য – প্রকৃত পক্ষে নতুন ওষুধ আবিষ্কার হওয়ার পর বাজারে আসার আগে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। মানুষের শরীরে এর নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কোন কোম্পানি বাজারে ওষুধ সরবরাহ করে না। অনেক সময় আবিষ্কারের কথা আমরা আগে জানতে পারি। তাই এটা মনে হতে পারে যেন ইচ্ছে করেই দেরী করা হচ্ছে। কিন্তু তা সত্য নয়।
সচেতন হন, সুস্থ্য থাকুন।
তারিখঃ ০৫/০২/২০২২